Dainik Sangbad – দৈনিক সংবাদ
Image default
FEATURED ট্রেন্ডিং

ডাঃ হিরন্ময় ঘোষাল: নেতাজির হয়ে চরবৃত্তি করা এক বাঙালি যাকে শাস্তি দিয়েছিলেন নেহেরু

ডঃ হিরন্ময় ঘোষাল বাংলার এক বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা, রায়বাহাদুর কালী সদয় ঘোষাল, তৎকালীন কলকাতার একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার খুড়তুতো ভাই পঞ্চানন ঘোষালও একজন ভারতীয় পুলিশ অফিসার ছিলেন যিনি পরে এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে একজন অগ্রগামী ক্রাইম ফিকশন উপন্যাসিক হয়ে ওঠেন।

বহুমুখী প্রতিভার ধারক ডঃ হিরন্ময় ঘোষাল ছিলেন একজন লেখক, সাংবাদিক, বহুভাষী, কূটনীতিক, অধ্যাপক এবং প্রথম পরিচিত ভারতীয় যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ডাঃ ঘোষাল ছিলেন একজন বহুভাষী প্রতিভা যিনি 26টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। বাংলায় নয়টি এবং ইংরেজিতে দুটি বইয়ের লেখক তিনি। এছাড়াও ডঃ হিরন্ময় ঘোষাল প্রথম ভারতীয় যিনি স্লাভিক গোষ্ঠীর ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি রুশ ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগোলের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেন এবং রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ডাঃ ঘোষাল সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় যিনি পোল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতার সাক্ষী হিসাবে তার উপর একটি বই লিখেছেন।

এমন একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন এবং এতবড় একজন পণ্ডিত হিসাবে নিজের কর্মজীবনে দেশের মাথা উচু করার পরেও ডাঃ হিরন্ময় ঘোষাল শুধুমাত্র তার নিজ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই নয়, তার জন্মভূমি ভারতেও আজ অবধি একটি অস্পষ্ট নাম হিসাবে থেকে গেছেন। কিন্তু কেন? জানলে চমকে উঠবেন!

কেন সকলে ভুলে গেলেন এই ভারতীয়ের বিষয়ে? মীরা এস ঘোষাল, ডাঃ ঘোষালের কন্যা, যিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী হালিনা কোসিনকিউইচের তরফে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বিষয়ে কিছু কথা ফাঁস করেছেন। মীরা এস ঘোষাল বলেছেন “বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমার বাবাকে আসলে তার নিজের দেশ ভারত থেকেই অস্বীকার করা হয়েছিল। মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাসে সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ভারত সরকার তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল।

মীরা ঘোষাল আরো বলেন “আমরা এখনও জানি না কেন তার মতো একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কে বিদেশ মন্ত্রকের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল… আমি সত্যিই জানতে চাই: তার অপরাধ কী ছিল?” মীরা জিজ্ঞেস করেন।

ডাঃ ঘোষালকে প্রাথমিকভাবে 1947 সালে মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাসে সাংস্কৃতিক বিভাগে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিত। ডাঃ ঘোষালের প্রতি তার তিক্ততা প্রকাশ পায় একটি “গোপনীয় ডেমি-অফিসিয়াল চিঠি” যা তিনি 29 মার্চ, 1948-এ বিদেশ মন্ত্রককে লিখেছিলেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমার আসল মাথাব্যথা হল ঘোষাল। তিনি এখানে সরকারি দোভাষী হিসেবে এলেও কিন্তু আমি কখনোই তাকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারিনি কারণ আমি তাকে বিশ্বাস করি না তিনি সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরিতে আগ্রহী যে কাজে তিনি এখানে এসেছেন।”

এছাড়াও চিঠিতে তিনি লিখছিলেন ডাঃ ঘোষাল কে তিনি অপছন্দ করেন। এবং বিদেশ মন্ত্রক কে লিখেছিলেন যদি ডাঃ ঘোষাল এর জন্য অন্য কোনো চাকরী দেখে তাঁকে রাশিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেন এত বিদ্বেষ পোষণ করেছিলেন জহর লাল নেহেরুর বোন। প্রসঙ্গত বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুও ঘোষালের প্রতি একই রকম মনোভাব দেখিয়েছিলেন। প্রকাশিত হওয়া ‘সিলেক্টেড ওয়ার্ক অফ জওহরলাল নেহেরু’ তে তার কিছু চিঠিতেই জানা যায় তিনি ডঃ হিরন্ময় ঘোষাল কে খুব একটা পছন্দ করতেন না। স্পষ্টতই, ভাই-বোন জুটি ঘোষালের “গবেষণা” এবং “বিদেশে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ” পছন্দ করেননি।

1950 সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যুক্ত হন। এবং ডাঃ ঘোষাল কে রহস্যজনকভাবে এবং বেশ ব্যাখ্যাতীতভাবে কয়েক মাসের মধ্যে ভারতীয় ফরেন সার্ভিস (IFS) থেকে ছাঁটাই করা হয়েছিল।

তার মেয়ে মীরা ঘোষাল বলেন, তাকে কূটনৈতিক চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পর, তিনি ভেঙ্গে পড়েন এবং ইংল্যান্ডে চলে যান। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তার প্রতি কোনো সুবিচার করেনি। তিনি কোনও উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পাননি এবং ফের তাঁর জন্মভূমি ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। 1956 সালে ভারতে ফিরে এসে ডঃ হিরন্ময় ঘোষাল বেশ রহস্যজনকভাবে ভারত, চীন এবং বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতিদের ভাষা অধ্যয়নের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই অঞ্চলটিই ব্রিটিশ ভারতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (INA) এর বিপ্লবের সাক্ষী ছিল।

1957 সালে, তার প্রথম স্ত্রীর দেশ, পোল্যান্ড -এ ডঃ ঘোষাল চাকরীর প্রস্তাব পান। তার প্রথম স্ত্রী অবশ্য মারা যান। পোল্যান্ডে গিয়ে তিনি অধ্যাক্ষের চাকরি নেন। এবং এক বছর পর মীরার মাকে বিয়ে করেন এবং পরের বছর, 1959 সালে তার কন্যা মীরা জন্মগ্রহণ করেন।

1963 সালে, কূটনীতিকের চাকরি থেকে বহিষ্কার এর 10 বছর পর ডক্টর ঘোষাল রাশিয়ায় একটি পারিবারিক সফর করেন।সফরকালে তিনি ছিলেন মস্কোতে, তাঁর কূটনৈতিক বৃত্তের একজন পুরানো বন্ধুর অফিসিয়াল বাসভবনে। যার নাম ছিল ত্রিলোকি নাথ কৌল। তিনি একজন ভারতীয় কূটনীতির এবং জহরলাল নেহেরুর মতো একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু তার পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করার পরে, আমার বাবা আমাদের বলেছিলেন, “কৌলের পরিবর্তন’ হয়েছে”, মীরা বলেন৷

খুব আশ্চর্যজনক ভাবেই আগামী কয়েক বছরের ভারতের রাজনীতিতে ত্রিলোকি নাথ কৌল এর ভূমিকা বেশ আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষণীয়। কৌল সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন যখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রহস্যজনক অবস্থায় মারা যান। কৌল তাসখন্দে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছিলেন এবং আধুনিক উজবেকিস্তানের রাজধানীতে শাস্ত্রী যে ভিলায় ছিলেন সেই একই ভিলায় থাকতেন।

11 জানুয়ারী, 1966-এ প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই, কৌল, মৃত শাস্ত্রীর শয্যার কাছে পৌঁছানো প্রথম ভারতীয় কর্মকর্তাদের একজন, যিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে কোনও ময়নাতদন্ত ছাড়াই যাতে শাস্ত্রীর মৃতদেহটি ভারতে ফেরত পাঠানো হয়। 1945 সালে নেতাজির অন্তর্ধানের সাথে শাস্ত্রীর মৃত্যুর সাথে বেশ কিছু যোগ আছে বলে জানা যায় যা অপ্রমাণিত। 24শে সেপ্টেম্বর, 1969 সালে, শাস্ত্রীর মৃত্যুর রহস্য মানুষের মন থেকে মুছে যাওয়ার সময় ডঃ ঘোষাল পোল্যান্ডের ওয়ারশতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এরপর ডক্টর হিরণময় ঘোষালের স্ত্রী ও কন্যার জীবন কিছুটা পাল্টাতে থাকে। তাদের উপর নজর রাখা হয়। শেষ অবধি তারা আমেরিকায় চলে যায়। পরে আমেরিকায় হিরণময় ঘোষালের কন্যার সাথে ভারতীয় কূটনীতিবিদ কৌলের দেখা হয়। তার মেয়ে ভারতে তার বাবার পরিবারের বিষয় তার কাছে জানতে চাইলেও কোন সদুত্তর পায়নি। অবশেষে মিরা ঘোষাল তার নিজ প্রচেষ্টায় তার বাবার পরিবারের একজনের সাথে যোগাযোগ করে।

“আমার কাকিমা এবং শান্তিময় ঘোষালের স্ত্রী বাসন্তী ঘোষাল আমাকে বলেছিলেন যে নেতাজি যখন বিভিন্ন ছদ্মবেশ ব্যবহার করে আফগানিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ভারত থেকে চলে গিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে জাপানের সহায়তা নিয়ে এশিয়ায় ফিরে আসার আগে জার্মানিতে অবস্থান করেছিলেন, তখন আমার দেশপ্রেমিক বাবা নেতাজির হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতেন।”

ডাঃ ঘোষালের হাতে লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরি, বর্তমানে মীরার কাছেই রয়েছে, এই সত্যটি নিশ্চিত করে যে তিনি অস্ট্রিয়াতে থাকাকালীন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং নেহরুর আহ্বান সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। যার মধ্যে ছিল কংগ্রেস যুব ব্রিগেডে যোগদানের জন্য নেহেরুর বোসকে আহ্বান এবং ভারতকে মুক্ত করার জন্য ডাঃ ঘোষালের মাধ্যমে বিদেশী শক্তির সমর্থন নেওয়ার নেতাজির পরিকল্পনা। এছাড়াও, বোস 1933-34 সালে পোল্যান্ডের রাজধানী পরিদর্শন করেছিলেন, একই সময়ে যখন ডঃ ঘোষাল ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

এখনো তার বাবার রাশিয়া থেকে চাকরী যাওয়ার কারণ তার কাছে সুস্পষ্ট নয়। “বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মুহূর্তে অনেকগুলি কাকতালীয় ঘটনা এবং কৌলের মতো কয়েকজনের উপস্থিতির কারণে আমার মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমার বাবা কি নেতাজিকে রাশিয়ায় দেখেছিলেন, নাকি নেতাজির মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে কিছু আবিষ্কার করেছিলেন?” জিজ্ঞাসা মীরার।

তার মেয়ে মনে করেন যে ” ডাঃ ঘোষাল প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছেন কারণ তাকে কূটনৈতিক চাকরি থেকে অপমানজনকভাবে অপসারিত করা হয়েছিল, এবং তিনি তার বাকি জীবনের জন্য সেই অপমান হজম করতে পারেননি”। “হয়তো তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি খুব বেশি কিছু জানতেন, এবং নেতাজির সাথে তার সান্নিধ্য তাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে থাকতে পারে। আমি এখনও জানি না কেন আমার বাবাকে তার নিজের দেশ এতটা অস্বীকার করেছিল,” আবেগপ্রবণ মীরা বলেছেন, তার বাবার মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই রহস্য উন্মোচন হওয়া।

ডঃ হিরন্ময় ঘোষালের কন্যা মীরা ঘোষাল বলেন ” আমি যদি মারা যাওয়ার আগে এই রহস্য জানতে পারি, তাহলে অন্তত শান্তিতে মরতে পারব।”

তথ্যসূত্র: India Today

Related posts

কাকে বানাবে বয়ফ্রেণ্ড? তরুণী টিন্ডার থেকে ডেকে পাঠালেন ৬ জন যুবক কে! তারপর যা হলো…

News Desk

চাকরিজীবীদের জন্য সুখবর, এবার একবারেই পাবেন PF-এর পেনশনের টাকা

News Desk

বন্ধ্যাত্বকরণ করিয়ে নিচ্ছেন এখানকার বেশিরভাগ পুরুষ! কেন জানলে চমকে উঠবেন

News Desk