১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পথে-পথে আকাশে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত করে স্লোগান তোলেন—‘জয় বাংলা’। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পথে। রাতভর আলো জ্বলে নির্ঘুম ঢাকা নগরীর ঘরে-ঘরে।
যুদ্ধের পটভূমিকা:
দুইশ’ বছরের শাসন শোষণ শেষে বিদায়কালে ব্রিটিশরা ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত করে যায়। জন্ম নেয় দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। দুই খণ্ডে বিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর পরইৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা) ওপর শোষক হিসেবে আবির্ভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি।
প্রকৃতই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ব্যাতীত অন্য কোন মিল ছিলনা।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরের ২৫ বছর সেই প্রভু-সুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে পদে পদে। সেইসাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে
এমনকি ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান এবং আইয়ুব খানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন সরকারি প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করে দেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইউএনএইচসিআর তথ্যমতে কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকে ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেন বাংলাদেশ সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিন্তু কৌশলগত কারণে ভারত ছিল তখন সাবধানী।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী বা যৌথ কমান্ড গঠন করলে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বদলে যেতে থাকে। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে কমান্ডের অধিনায়ক করা হয় এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান হন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকষ। পাকিস্তান সরকার ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
পাকিস্তান এ সময় কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল। এজন্য ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান অতর্কিতভাবে ভারতের বিমান ঘাঁটি, অমৃতসর, পাঠানকোট, আগ্রা ও শ্রীনগর এর ওপর বিমান হামলা চালায়।
১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর বিকেল।
এ সময় ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ’র একটি টেলিফোন আসে ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক জেকবের কাছে।
জেনারেল জেকবকে সেনাপ্রধান মানেকশ যে বার্তা দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে, পাকিস্তানী বিমান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এয়ারফিল্ডগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করার জন্য জেনারেল জেকবকে পরামর্শ দেয়া হয়। অবশেষে ভারত সিদ্ধান্ত নেয় যুদ্ধে প্রত্যক্ষ রূপে অংশগ্রহণের। এবং এর কিছু দিনের মধ্যেই পাকিস্তান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের এই ঐতিহাসিক দলিলটি স্বাক্ষরিত হয় রমনার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), ৪টা ১ মিনিটে। দলিলে স্বাক্ষর করলেন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর পক্ষে কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, আর যুদ্ধরত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।
মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রায় ২৩০৭ সৈনিক নিহত হয়েছে আর আহত হয় প্রায় ৬১৬৩ জন। সেনাদের মধ্যে নিখোঁজ হন ২১৬৩ জন। সমরাস্ত্রের মধ্যে ৭৩ টি ট্যাংক ও ৪৫ টি জঙ্গীবিমান নিখোঁজ হয়। এটি ছিল জানা কিছু ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও ভারত বাংলাদেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশে সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।