সকল গ্রহের অধিপতি দের মধ্যে শনি গ্রহের অধিপতি শনিদেব কে সবচেয়ে রাগী দেবতা বলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন। শনির সাড়ে সাতি দশা নাম শুনে আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে বিশ্বাসী প্রায় সকল মানুষেরই। বলা হয় শনির দৃষ্টি যার উপর পড়বে তার খারাপ সময় শুরু হয়। আর একবার শনির খারাপ দৃষ্টি পড়লে তা সহজে কাটেও না। কেননা শনির গতি বড় ধীর। তাই অবস্থান পরিবর্তন করতে এর দীর্ঘ সময় লাগে। শনিদেবের বক্র দৃষ্টি কারণে ভক্তরা তাকে ভয় বেশি পান। দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। কিন্তু কেন এমনটা? কি বলছে জ্যোতিষ বা পুরান!
আসলে শনিদেব ন্যায়ের পদে অটুট ছিলেন আর সে জন্য তিনি অনেকের কাছে বিশেষ প্রিয় নন। যাকে যার কর্মফল দিতে গিয়ে অনেকের ক্ষতিও হয় তার দ্বারা। কিন্তু মৎস্য পুরাণ অনুযায়ী শনি শুভ গ্রহ। কর্মফল প্রদান করলেও বিনা কারণে তিনি শাস্তি দেন না। যে মানুষ ভালো কাজ করে আর সঠিক কাজ করেন শনির বক্রদৃষ্টি তার কোন ক্ষতি করেনা। আর যে ব্যক্তি খারাপ কাজ করে শনির বক্রদৃষ্টি তার শাস্তি নির্ধারণ করে আর সেই ব্যক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসে। কিন্তু তাহলে তার দৃষ্টি এত ভয়ঙ্কর কেন আমার। এত ক্রোধই বা কেন তার?
বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে শনির ক্রোধ সম্পর্কে নানা কাহিনি রয়েছে। মৎস্য পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার মেয়ে সঞ্জনার সঙ্গে বিবাহ হয় সূর্যদেবের। কিন্তু সূর্যের প্রচণ্ড তাপ সহ্য করতে পারেন না সঞ্জনা। ঝলসে গিয়ে তার নাম হয় সন্ধ্যা। স্বামীর সাথে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই পরিত্রাণ পেতে তিনি নিজের হুবহু একটি প্রতিকৃতি সৃষ্টি করেন। তাঁর নাম দেন ছায়া। ছায়ার হাতে সূর্যের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যা ফিরে যান পিতা গৃহে। সূর্যদেব জানতে পারেন না।
সূর্য ও ছায়ার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন শনি। এই খবর কানে যেতেই বিশ্বকর্মা সন্ধ্যার কাছে সব জানতে চান। ছায়ার কাহিনী শুনে তখনই নিজের কন্যাকে পতিগৃহে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। সন্ধ্যা ফিরে গিয়ে ছায়াকে সূর্যদেবের অগোচরে নিঃশেষ করে নিজে ফের সূর্যের স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। কিন্তু ছায়ার সন্তান শনির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করেন।
এরপর সূর্যের ঔরসে সন্ধ্যার গর্ভে জন্ম নেয় যম এবং যমুনা। এরপর শনিদেবের সাথে আরো দূরত্ব তৈরি হয় তার। মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত শনিদেব হয়ে ওঠে বিরক্ত ও রাগী।
সূর্যদেবের সন্তান সন্ততিরা উপযুক্ত হলে তাদের প্রদান করা হয় দায়িত্ব। সন্ধ্যার প্রভাবে বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শনিকে কোনও দায়িত্বই দেন না। সূর্য যমকে দিলেন ধর্মরাজের অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে ধর্মরক্ষার দায়িত্ব। যমুনা পবিত্র নদীর রূপ নিয়ে সব সকল পাপ ধুয়ে বয়ে চলার দায়িত্ব পান।
বঞ্চিত শনিদেব রাগে সন্ধাকেই পত্রঘাত করেন। আর সন্ধ্যাও শনিকে খোঁড়া হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন। নিজের সন্তানের প্রতি মায়ের অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা বিরল। সন্ধ্যার এই আচরণ সূর্যদেবকে অবাক করে। সন্ধ্যার কাছে তিনি সব জানতে চান। সূর্যের প্রশ্নে ভেঙে পড়ে তাঁকে নিজের কৃতকর্মের কথা সন্ধ্যা। এরপর সূর্যদেব শনিকে ন্যায় পালনের দায়িত্ব দেন। কিন্তু তার উপর হওয়া অবিচারের কারণেই শনি কারো কুকর্মের শাস্তি তাকে দেন।
আর শনির দৃষ্টি নিয়ে আরো একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে।
শনি দেব সংসার জগতের বিষয়ে নির্লিপ্ত ও সন্যাসী ছিলেন। কিন্ত এক বিশেষ কারণে বিবাহ বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হন। শনি দেব এর বিবাহিত পত্নীর নাম দেবী ধামিনী, তিনি এক গন্ধর্ব কন্যা। অতি সুন্দর এবং গুণবতী নারী। কিন্তু বিবাহের পর শনিদেব তার দিকে নজর দেন না। দুদিন অতিক্রান্ত হলেও শনি দেব তার স্ত্রী ধামিনীর দিকে ফিরে না থাকালে ধামিনী তাকে অভিশাপ দেন। এই অভিশাপ ছিল তুমি যেমন আমার দিকে তাকাওনি তাহলে আর কারো দিকে দৃষ্টি দিতে পারবে না। তোমার দৃষ্টি পড়লে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য এই অভিশাপ এর কারণ হলো মঙ্গল দেব সেই সময়ে ধামিনীর মনের উপর প্রভাব ফেলে তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। আর শনি দেব সেই অভিশাপ মেনেও নেয়। সেই কারণে শনি দেবের এই বক্র দৃষ্টি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে।