কলেজের পড়াশুনা কিংবা আড্ডায় কিংবা কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে বাঙালির এক অলিখিত সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। বাঙালির সত্ত্বায় মিশে আছে বইয়ের গন্ধ, আর এই বইয়ের সেরা ঠিকানা আমাদের কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘পুরনো’ বইয়ের বাজার এটি। আশেপাশের প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় নামী প্রতিষ্ঠান এবং বাংলার বহু গুণী মানুষের স্মৃতিধন্য এই কলেজ স্ট্রিটের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরনো।
তিনটি গ্রাম নিয়ে ভাবে গড়ে ওঠার পর কলকাতা শহর কে নিজের রাজধানী বাছেন ব্রিটিশরা। রাজধানীর মতই সাজিয়ে তুলতে চান সেই অনুযায়ী তৈরি হয় পরিকল্পনা। রাজধানী হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চওড়া ও ভাল রাস্তাঘাটের। যাতে চলাচলের ক্ষেত্রে সমস্যা না হয়।
অষ্টাদশ শতকের শেষ লগ্নে ফোর্ট উইলিয়ামের জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন লর্ড ওয়েলেসলি। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি সামলে মন দেন কলকাতা শহরকে গড়ে তুলতে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় ‘লটারি কমিটি’। লটারি থেকে আয় হওয়া টাকায় হয় কলকাতা শহরের উন্নয়ন। লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে এরপরে ১৮০৬ সাল থেকে ১৮৩৬, এই সময়কালের মধ্যে পুরো কলকাতায় তৈরী হয় আর্টেরিয়াল সড়ক। সেই সময়ই তৈরী হয় একটি সড়ক আজকে যার নাম কলেজ স্ট্রিট।
প্রথমে কিন্তু এই সড়কের তৈরীর সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই সড়ক নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেই সময়ের ব্যারাকপুর ও দমদম এর ব্রিটিশ সেনাছাউনির সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামের যোগাযোগকে সুষ্ঠু ও দ্রুত করা যায়। যাতে প্রশাসনিক কাজকর্ম সামলাতে সুবিধা হয়, সেনাদের যাতে রসদ পৌঁছতে সমস্যা না হয় ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখেই তৈরী হয়েছিল এই সড়ক।
আজকের কলেজ স্ট্রিট দিয়ে তখন নিয়মিত যেত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। কিন্তু ক্রমে এই রাস্তার পরিচয় গড়ে ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কে কেন্দ্র করেই। আর এর মূলে রয়েছে হিন্দু কলেজ, বা আজকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও এর আগেই এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সংস্কৃত কলেজ’। কিন্তু রাস্তার নামের সঙ্গে ‘কলেজ’ কথাটি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।
তবে হিন্দু কলেজের শুরু এই অঞ্চলে হয়নি। মাত্র ২০ জন ছাত্রকে নিয়ে প্রথম পড়াশুনা শুরু হয়েছিল গরানহাটায় যা আজকে চিৎপুর নামে পরিচিত। স্থান ছিল গৌরচাঁদ বসাকের বাড়িতে। মূলত হিন্দু পরিবারের ছাত্রদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন হলেও কলেজের দরজা খোলা ছিল অহিন্দুদের জন্যেও। গৌরচাঁদ বসাকের বাড়িতে ঘরভাড়া করে কয়েক দিন পড়াশুনা চলেছিল।
এরপর ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয় কলেজ চিৎপুরের আর একটি ঠিকানায়। এরপর বৌবাজারের আরো এক ঠিকানায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত আজকের কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানায় এসে পৌছায় হিন্দু কলেজ। এর পঠনপাঠন হতে থাকে সংস্কৃত কলেজে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আজকে যে ভবন দেখি প্রেসিডেন্সি কলেজের তা তৈরী হয় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ।
জায়গাটির চালচিত্র দ্রুত বদলে গেল হিন্দু কলেজ নতুন ঠিকানায় আসার সঙ্গে। এই এলাকার পরিচিতি ঠনঠনিয়া থেকে কলেজপাড়া হয়ে গেলো । এরপর এই এলাকার নাম আরো বেশ কয়েক বছর পর কলেজ স্ট্রিট হল । এখানে পড়ুয়া সমাগম স্বভাবতই বৃদ্ধি পেল। বইয়ের চাহিদাও মাত্রাতিরিক্ত বাড়লো।
তখনও এখানে ছিল না আজকের মতন ফুটপাথ। রাস্তার ধারে চট বিছিয়ে পুরনো বইপত্র বেচাকেনা চলত। সবই ইংরাজি বই। এরপর কলেজ স্ট্রীটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুরু করেন প্রথম বাঙালি বইয়ের দোকান ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’। পরবর্তীতে মদনমোহন তর্কালঙ্কারও শুরু করেছিলেন বইয়ের ব্যবসা। আস্তেআস্তে সময়ের সাথে কলেজ স্ট্রিটে বাড়তে থাকে বইয়ের ব্যবসা। এই ভাবেই অল্প অল্প করে প্রসার লাভ করে আজকের কলেজ স্ট্রিট। বইপ্রেমীদের সেরা ঠিকানা কলকাতার কলেজ স্ট্রিট। তথ্য সূত্র: আনন্দবাজার।