ভারতীয় সঙ্গীত জগতের নামকরা গায়কদের মধ্যে বাঙলী জাতির গর্ব কিশোর কুমার ছিলেন অন্যতম। তাঁর মতো প্রতিভাশালী গায়ক ভারতের বুকে কমই জন্মেছে। প্রথাগত তালিম ছাড়াই হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের অন্যতম গায়ক। ‘বিস্ময় প্রতিভা’ শব্দটা যেন তাঁরই জন্যে তৈরী। কিশোর কুমার (Kishore Kumar) যেমন ছিলেন একধারে গায়ক তেমনই অপরদিকে তিনি ছিলেন নামকরা একজন গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, সিনেমার নির্দেশক, রেকর্ড প্রযোজক এবং পরিচালকও। তাঁকে আজও তার মৃত্যুর অনেক বছর পরেও তাকে ভারতের সর্বকালের সেরা এবং সফল প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে মনে করা হয়।
তিনি কিশোর কুমার। আজ তার ৯২তম জন্মবার্ষিকী। আজকের দিনে ফিরে দেখা সেই কিংবদন্তির প্রতিভার জীবনের কিছু জানা-অজানা তথ্য।
কিশোর কুমারের আসল নাম আভাস কুমার। আইনজীবী কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী গৌরীদেবীর ঘরে তার জন্ম ১৯২৯-এর ৪ঠা অগস্ট। কিশোর কুমার বলিউডে তাঁর যাত্রা শুরু করেন ‘বম্বে টকিজ’ সিনেমায় কোরাস গায়ক হিসেবে। কিশোর কুমার যখন ছোট ছিলেন তখনই তাঁর দাদা অশোক কুমার বলিউডে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। তিনি চেয়েছিলেন তার ভাইও সেই পথ অনুসরণ করুক। কিন্তু কিশোর কুমার এই নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন না। কিশোর কুমারের অভিনেতা হিসেবে সিনেমায় আত্মপ্রকাশ ঘটে শিকারি (Shikari) সিনেমার মাধ্যমে। এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অশোক কুমার। তারপর ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে ২২টি ছবি আসে কিশোর কুমার অভিনীত। তাঁর মধ্যে ১৬টি ফ্লপ ছবি। এক ঘরোয়া আড্ডায় আরেক কিংবদন্তি শচীনদেব বর্মন তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নিজস্ব গলার গায়কি তৈরি করতে। এর পর কিশোর কুমার তাঁর গায়কিতে পাশ্চাত্য প্রভাব আনেন। ধীরে ধীরে সিনেমার জগতে রাজেশ খন্না, জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ, অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠ হয়ে ওঠেন কিশোর কুমার।
জীবনে কোনওদিন সমঝোতার রাস্তা বেছে নেননি কিশোর কুমার। ইমারজেন্সি চলাকালীন তাঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা দল কংগ্রেসের। এর কারণে ১৯৭৬ থেকে ইমারজেন্সি শেষ হওয়া অবধি অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শনে তাঁকে ব্যান করা হয়েছিল।
জীবনে ৪ বার বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমার। প্রথম স্ত্রী রুমা গুহঠাকুরতা ও তার সন্তান অমিত কুমারের জন্ম ১৯৫২ সালে। তার জন্মের পর থেকেই মনোমালিন্য শুরু হয় তাদের। আট বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল তাদের। বিচ্ছেদের আগেই সম্পর্কে জড়ান দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালার সাথে। তার সঙ্গে নয় বছর সংসার করেন। মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন কিশোর কুমার। নাম নেন করিম আবদুল। কিশোর কুমার এবং মধুবালার দাম্পত্য প্রথম থেকেই সুখের হয়নি। শোনা যায়, বিয়ের মাত্র এক মাস পরেই ভীষণ রকম অসুস্থ মধুবালা চলে যান তাঁর নিজের বাংলোয়। ১৯৬৯ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রে থাকা ফুটোর কারণে প্রয়াত হন মধুবালা। অভিযোগ, তাঁর শেষ জীবনে কোনো যোগাযোগ রাখেননি কিশোর কুমার।
মধুবালা প্রয়াত হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর পর যোগিতা বালীর প্রেমে পড়েন কিশোর কুমার। তবে জানা যায় কিছুদিন পরেই খোয়াব’ ছবির শুটিংয় চলাকালীন মিঠুন চক্রবর্তীর প্রেমে পড়েন যোগিতা বালী। মাত্র দুই বছরের দাম্পত্যে তাদের সুখী হয়নি। এই কারণে চরম সীমা ছোয় কিশোর কুমারের সঙ্গে মিঠুনের বিরোধ। চতুর্থবার বিয়ে করেন কাজের সুবাদে আলাপ হওয়া দক্ষিণী নায়িকা লীনা চন্দ্রভারকরকে। ২১ বছরের বড় হওয়ার কারণে লীনার পরিবারের এই বিয়েতে আপত্তি ছিল। কিন্তু তারা ১৯৮০তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
আমৃত্যু তাঁর সঙ্গেই ছিলেন কিশোর কুমার। ১৯৮২ সালে কিশোর কুমারের দ্বিতীয় সন্তান সুমিত কুমার জন্ম নেয়। আর তার মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ১৯৮৭ সালে মারা যায় কিশোর কুমার। তবে বৈমাত্রেয় হলেও সুমিত কুমার আর অমিত কুমারের বন্ধন হার মানিয়ে এক মায়ের পেটের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ককেও। নিজের সারা জীবনে সুখী হয়নি কিশোর কুমার। চিরকাল নিজের চোখের জল লুকিয়ে চিরকাল মানুষকে হাসিয়ে গিয়েছেন।