ফুলঘরা গ্রামে যদি কাউকে জিগ্যেস করেন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব কী? তবে যে উত্তর মিলবে তাতে আপনি আশ্চর্য হয়ে যেতে বাধ্য। বাকি-বঙ্গে যা-ই হোক, এখানে অন্তত বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো নয়, মনসা পুজো। বছরের পর বছর ধরে পুজোর চারদিন মা মনসার পুজোতেই মাতেন ফুলঘরার আট থেকে আশি। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট ব্লকের বোয়ালদাড় পঞ্চায়েতের ফুলঘরা গ্রামবাসীরা দেবী দুর্গার আসনে মা মনসাকেই বসিয়েছেন দীর্ঘ দিন হল। তাঁদের কাছে শারদ আনন্দে সামিল হওয়ার অর্থ মনসাপুজোয় সামিল হওয়া। দুর্গা পুজোর নিয়ম মেনেই এখানে মনসা পূজিত হন।
কথিত আছে, প্রায় সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্গার বদলে মনসার পুজোই হয়ে আসছে এই ফুলঘরায়। পুরনো রীতি-রেওয়াজ কিছুই বদলায়নি আজও। মা মনসার কাছে নিষ্ঠাভক্তি-সহকারে কোনও কিছু চাইলে তা পূর্ণ হয় বলেই বিশ্বাস গ্রামবাসীদের।
জনশ্রুতি, বহুকাল আগে ফুলঘরার বহু ব্যক্তি সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিলেন। শুধু মানুষ নয়, সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিল অনেক গবাদি পশুও। কোনও ভাবেই এই সর্পাঘাতে মৃত্যু বন্ধ করতে পারছিলেন না গ্রামবাসীরা। সেই সময়ে এক গ্রামবাসী স্বপ্ন দেখেন, গ্রামে মনসা পুজো করলে কেউ আর সর্পাঘাতে মারা যাবেন না। আত্রেয়ী নদীতে একদিন স্নান করতে গেলে তিনিই মা মনসার কাঠামো ভেসে যেতে দেখেন। গ্রামবাসীরা সেই কাঠামো তুলে নিয়ে এসে মন্দিরে স্থাপন করে মনসাপুজো শুরু করেন। প্রথমে শ্রাবণ মাসেই এই পুজো শুরু হয়েছিল। তবে গোটা এলাকায় দুর্গাপুজো না হওয়ায় সময়টা বদলে শারদোৎসবের দিনগুলিতেই মা মনসার পুজো শুরু হয়।
পুজোর কয়েকটা দিন চণ্ডী ও মনসামঙ্গলের গান হয় এখানে। এখানে মা মানসার এক পাশে থাকেন মা লক্ষ্মী। অপর দিকে সরস্বতী। পুজোর চার দিন নিয়ম মেনে গ্রামের সকলে নিরামিষ খান। আজও এই পুজোকে ঘিরে মেতে ওঠেন গ্রামের আট থেকে আশি। পুজো প্রাঙ্গণে নাটক থেকে যাত্রাগান অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর দিনগুলিতে মেলা বসে ফুলঘরায়। শোনা যায়, এই পুজো শুরু হওয়ার পর থেকে এই গ্রামে আর সর্পাঘাতে কেউ মারা যাননি। বংশ পরম্পরায় পুরোহিত, মৃৎশিল্পী প্রমুখ কাজ করে আসছেন। পুজোর বায়না দিতেও হয় না। সময়মতো সকলেই চলে আসেন।