চারদিকে যখন অসুরদলনী দুর্গা বন্দনায় মুখর গোটা রাজ্য। তখন আদিবাসী সমাজে উলটপুরাণ। আদিবাসী সমাজে বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্গা নয়, পুজো পায় মহিষাসুর। ঝাড়খন্ড লাগোয়া পুরুলিয়া,পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ির চা-বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁদের বাস। এরা ‘অসুর’ জনজাতি। দুর্গাপুজোর পাঁচদিন থেকে এরা শোক পালন করেন। আজও পুজোর চার দিন তাঁদের প্রিয় রাজা হুদুর দুর্গাকে গ্রামান্তরে খুঁজে বেড়ান আদিবাসীরা।
হিন্দু পুরাণে দুর্গা শুভশক্তি আর মহিষাসুর অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছেন। বলা যায়, আর্য-অনার্যের যুদ্ধে প্রথমপক্ষ জয়ী হয়। অশুভের বিনাশে পালিত হয় আনন্দোৎসব।
কিন্তু, আদিবাসী সমাজ বিশ্বাস করে প্রাগৈতিহাসিক যুগে হুদুড় দুর্গা ছিলেন সাঁওতাল সমাজের রাজা। ইনিই আসলে মহিষাসুর। তিনি চাইচম্পা নামক স্থানে রাজত্ব করতেন। তাঁর রাজত্বে সাঁওতালদের মধ্যে সুখ ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত। এরই মধ্যে আসে আর্যরা। তারা সাঁওতালদের রাজ্য দখল করতে যায়। কিন্তু হুদুড় দুর্গার বীরত্বের কাছে হার মানে আক্রমণকারীরা। এরপর তারা চক্রান্তে সামিল হয় এবং সাঁওতালরাজকে পরাস্ত করার রাস্তা খুঁজতে থাকে। তারা জানতে পারে যে সাঁওতাল রাজা তথা সাঁওতাল সমাজের মানুষজন নারীর ওপর বলপ্রয়োগ বা আঘাত করে না। তাই অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিনিধি এক সুন্দরী নারীকে পাঠায়। হুদুড় দুর্গাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। একজন পুরুষ হিসেবে হুদুড় দুর্গা সেই প্রস্তাবকে সম্মান জানায় এবং প্রকারান্তরে পাতা ফাঁদে পা দেয় হুদুড় দুর্গা। ওই রমণী আসলে আর্যদের চর হিসেবে কাজ করে এবং আদিবাসী সমাজের গোপন তথ্য পাচার করে। একই সঙ্গে ভালোবাসার ছলে সাঁওতালরাজকে বিবাহ করে এবং সুযোগ বুঝে তাকে হত্যা করে।
দুর্গাপুজোর আনন্দ-উৎসবে যোগ দেয়না ওরা। তাই ঢাকের আওয়াজ কানে গেলে এখনো কানে আঙুল দেন অসুর জনজাতির প্রবীনেরা। তাদের বিশ্বাস দুর্গা অনৈতিক উপায়ে, ছলনার আশ্রয় নিয়ে সাঁওতাল জনজাতির রাজাকে হত্যা করেছে। সে-কারণে সাঁওতালরা মহিষাসুরকে তাদের বীর পূর্বপুরুষ বলে মনে করে আর দুর্গা তাদের কাছে চক্রান্তকারী তথা হত্যাকারী।
তাঁদের বিশ্বাস আজও রয়েছেন হুদুর দুর্গা। আর তাই দুর্গাপুজোর এই চারদিন হুদুর দুর্গাকে খুঁজে বেড়ান তাঁরা। পুজোর পাঁচ দিন তাই দাসাইয়ের গানে এদেশের আদিবাসী ভূমিপুত্ররা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নার সুরে খুঁজে চলেন ওদের ‘রাজা’ মহিষাসুরকে। আজও বর্ধমান, পুরুলিয়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলার নানা প্রত্যন্তে ‘হায়রে’ ‘হায়রে’ ধ্বনি করে শাড়ি পরে পুরুষদের শোকাবহ নাচ দেখতে পাওয়া যায়।