একটি মাত্রই সন্তান। তাকেই পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছেন নিজের পরিবারের লোকেরা। সারা দিন ধরে শিকলে বাঁধা অবস্থাতেই বাড়ির উঠোনের এক পাশে রয়েছে ২৫ বছর বয়সী বিষ্ণু। তবে এইটুকু পরেই ভেবে নেবেন না যে কোনো অমানবিকতার ছবি তুলে ধরা হচ্ছে এইখানে। বিষ্ণুর বাবা মা নিজের একমাত্র ছেলের উপর কোনো অত্যাচার করতে নয়, নিতান্ত অসহায় হয়েই নিজেদের মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলা সংবাদ মাধ্যম এই সময়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে এই পিতা মাতার সংগ্রামের কাহিনী। মেখলিগঞ্জের রানীরহাটে বসবাস করেন নবীন রায় ও প্রতিমা রায়। কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন নবীন রায়। নিজেদের একমাত্র মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলে সুস্থ হয়নি।
নবীনবাবু বলেন, শুরুর দিকে মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ দেখা দিলেও উত্তেজিত হত না এতটা বিষ্ণু। তাকে সামলানো তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিষ্ণুর আচার আচরণ বেশ চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। সে সমানে সুযোগ খোঁজে বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে। বাবা, মা বা পরিবারের কেউ আটকাতে এলে মারধর করে। সেজন্যই অসুস্থ একমাত্র ছেলেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। এর সমাধান খুঁজতে যদি ছেলের চিকিৎসার কিছুটা উপায় করে দেওয়ার জন্য সরকারি সাহায্যের জন্যে কাছে আবেদনও করেছেন নবীনবাবু। কিন্তু সরকারের তরফে এখনও সেইভাবে কোনো সুরাহা মেলেনি বলে আক্ষেপ তাঁর।
প্রায় ৩০ বছর আগে মেখলিগঞ্জের রানিরহাটের বাসিন্দা নবীন রায়ের সাথে নিকটবর্তী এলাকার সারহাটির বাসিন্দা প্রতিমা রায়ের বিয়ে হয়। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর জন্ম হয় তাদের সন্তান বিষ্ণুর। বিষ্ণু অন্যান্য বাচ্চার মতই সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জন্মেছিল। পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিল সে। কিন্তু, রানিরহাটের শৌলমারি স্কুলের তুখোড় ছাত্র বিষ্ণু রায় স্কুল পাশ করার পরই হঠাৎ করেই যেন তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
মা প্রতিমাদেবীর জানান, ‘প্রায় ছয় বছর আগে থেকে ছেলের মধ্যে হঠাৎই কিছু অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম থেকেই ছেলের চিকিৎসা শুরু করি। ছেলের মানসিক আচার আচরণের স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে দরকার ছিল প্রচুর টাকার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য দরকারি অর্থের যোগান দিতে জমি-জমা বিক্রি করতেও ভাবেননি একবারও। কিন্তু কোনও চিকিৎসায় লাভ হয়নি। এখন নিজেদের প্রায় সবটাই হারিয়ে ছেলের চিকিৎসা করানোর জন্য আর সামর্থ্য নেই।’ নবীনবাবু জানিয়েছেন গত ছয় বছর ধরে শিলিগুড়িতে বিষ্ণুর চিকিৎসা করিয়েছেন তারা।
শুধু তাই নয় ধূপগুড়িতে আর মাথাভাঙাতেও বিষ্ণুর চিকিৎসা করিয়েছেন তারা। কিন্তু কোনো চিকিৎসাতেই ফল মেলেনি। বিষ্ণুর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ডাক্তারের ফিস আর ওষুধ জোগার করতে তার বাবা মা নিজেদের সম্বল চাষের জমি-জমাও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পরের জমিতে যোগাল খেতে হতদরিদ্র হয়ে পড়েছেন তারা। ছেলের চিকিৎসা তো দুর, তাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা! ফলে ছেলের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আর এই হতদরিদ্র পরিবারের নেই। আবার দিন-রাত ছেলেকে শিকল বাঁধা অবস্থায় দেখে অসহায় বাবা-মা আরো চোখের জল ফেলছেন। তাই নবীনবাবু ও প্রতিমাদেবীর সরকারের কাছে কাতর আবেদন, সরকারি তাঁদের সন্তান বিষ্ণুর দায়িত্ব নিক।