Dainik Sangbad – দৈনিক সংবাদ
Image default
FEATURED ট্রেন্ডিং

বিপদে ২৫ লাখ টাকা ঋণ বান্ধবীর! ফেরত চাইতেই মহিলার সাথে ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনা

প্রত্যেক অপরাধী অপরাধ করার পর মিথ্যা বলে। কিন্তু অনেক সময় পুলিশও অপরাধ ফাঁস করতে এবং প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে মিথ্যা বলে। গুজরাটের ভালসাদে চাঞ্চল্যকর এক খুনের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ এমন মিথ্যা কথা বলেছে যে খুনি নিজেই সব সত্য বলে দিয়েছে। চলুন জানা যাক এই মর্মান্তিক ঘটনার পুরো ঘটনা।

২৮শে আগস্ট ২০২২, গুজরাটের ভালসাদ শহরের পারদি এলাকায় একটি নদীর তীরে সেদিন ভোরে একটি গাড়িতে একটি মহিলার মৃতদেহ পাওয়া যায়। নির্জন স্থানে পার্ক করা গাড়ির পেছনের সিটে পড়ে ছিল এই লাশ। তা দেখে কয়েকজন পুলিশকে ডাকে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গাড়ি ও লাশের অবস্থা দেখে বুঝতে সময় লাগেনি যে এটি একটি হত্যা মামলা। কারণ লাশের শরীরে শ্বাসরোধের চিহ্ন ছিল। যেভাবে উপর থেকে লাশ গাড়িতে ভরে রাখা হয়েছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে তা ঘটতে পারত না। এছাড়া সেখান থেকে গাড়ির চাবি, মহিলার মোবাইল ফোনের মতো জিনিসও পাওয়া যায়নি।

এই মামলার তদন্ত আরও এগিয়ে নিতে, নিহত মহিলার পরিচয় খুঁজে বের করা পুলিশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন পুলিশ নিজে থেকেই এমন একজন মহিলার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতে পায়। এদিকে ভালসাদ শহরের এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর নিখোঁজ রিপোর্ট দায়ের করেছিলেন। হরেশ বালসারা, যিনি রিপোর্টটি লিখেছেন, তিনি তার ডায়েরিতে বলেছিলেন যে তার স্ত্রী কারও সাথে দেখা করতে যাওয়ার অজুহাতে ২৭ আগস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু তার পরে তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল এবং তিনি বাড়িতেও ফিরে আসেননি।

এমন অবস্থায় পারদীর নদীর তীরে পাওয়া লাশ শনাক্ত করতে পুলিশ হরেশের সাথে যোগাযোগ করে তাকে ঘটনাস্থলে ডেকে পাঠায়। তার স্ত্রীর গাড়ি এবং তার লাশ দেখে, হরেশ অঝোরে কেঁদে ফেলল এবং স্পষ্ট হয়ে গেল যে এই মৃত মহিলা হরেশের স্ত্রী বৈশালী বালসারা। এই অবধি, পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি, আশেপাশের লোকেরাও হরেশ এবং তাঁর স্ত্রী বৈশালীকে চিনতে পেরেছিল। কারণ হরেশ ও বৈশালী ছিল এই এলাকার মানুষের কাছে পরিচিত মুখ। বৈশালী একজন বিখ্যাত গরবা গায়ক ছিলেন, তার স্বামী হরেশও একজন পাকা গিটারিস্ট ছিলেন।

বৈশালী হত্যা নিয়ে অনেক প্রশ্ন কিন্তু বড় প্রশ্ন ছিল বৈশালীকে কিভাবে খুন করা হলো? শহরের এই নির্জন জায়গায় কে তার নিজের গাড়ির ভিতর প্রাণ কেড়ে নিল? কারো সাথে তার কি শত্রুতা ছিল? এটা কি কোনো সম্পর্কের ঝামেলার ফল ছিল? সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ? অথবা অন্য কিছু? পুলিশ বৈশালীর দেহ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠায়। এই মামলা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল পুলিশ।

বৈশালীর স্বামী হরেশকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। কিন্তু মামলার তদন্তে হরেশের কাছ থেকে তেমন সাহায্য মেলেনা। কারণ হরেশ পুলিশকে জানিয়েছে যে শনিবার বৈশালী বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল এই বলে যে সে কারও সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, তবে সে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানায়নি। এমতাবস্থায় তারও কোনো ধারণা নেই যে, জীবনের শেষ সময় বৈশালী কার সঙ্গে ছিল? হরেশের সাথে কথা বলার সময় পুলিশ বুঝতে পেরেছিল যে সে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে না। অর্থাৎ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরই সন্দেহের মধ্যে ছিলেন বৈশালীর স্বামী হরেশ। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের সামনে বৈশালীর অজ্ঞাতনামা শত্রুকে খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেল।

বৈশালীর মোবাইলের সিডিআর থেকে পাওয়া ক্লু এর সাহায্যে ভালসাদ পুলিশ প্রযুক্তিগত নজরদারির সাথে বিষয়টি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৮টি পুলিশ দল গঠন করা হয়েছিল, যাদের তাদের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ বৈশালীর বাড়ি থেকে ঘটনা পর্যন্ত পুরো রুটের সিসিটিভি ফুটেজ স্ক্যান করতে শুরু করে এবং সেই সঙ্গে বৈশালীর মোবাইল ফোনের সিডিআর অর্থাৎ কল ডিটেইল রেকর্ড পাওয়া যায়। এই প্রচেষ্টায় পুলিশ দুটি ক্লু পায়। পুলিশ সিডিআরে দেখেছে, বৈশালীর বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ও পরে ববিতা নামের এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল। যেখানে ২৭ তারিখ সন্ধ্যার ঘটনাকে ঘিরে কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরায় ববিতার নড়াচড়া দেখা যায়। অর্থাৎ এই দুটি জিনিস একে অপরের সাথে মিলে যাচ্ছিল।

অন্তঃসত্ত্বা বান্ধবী ববিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। ববিতা ছিল বৈশালীর বন্ধু। কিন্তু সমস্যা হলো সন্দেহের আওতায় থাকা ববিতা নিজেই নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এমন পরিস্থিতিতে তাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করাও কঠিন ছিল। কারণ এতে ববিতার পাশাপাশি তার গর্ভের সন্তানের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এরপর মেডিকেল অফিসারের উপস্থিতিতে ববিতা পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে। ববিতার বিরুদ্ধে কারিগরি প্রমাণ এবং তার শারীরিক ভাষা দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ডে অবশ্যই তার হাত রয়েছে। কিন্তু সবগুলো লিংক তখনও সংযুক্ত হয়নি।

পুলিশ ববিতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, প্রথমে ববিতা ২৭ তারিখ নগরীর পারদী এলাকার দিকে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ যখন সিসিটিভি ফুটেজ আছে বলে জানায়, তখন সে রাজি হয় যে হ্যাঁ, সন্ধ্যায় সে নগরীর পারদী এলাকার দিকে পারদির দিকে গেল এবং সেখানে তার বন্ধু বৈশালীর সাথে দেখা হয়। পুলিশ তাকে তার কথায় ফাঁসানোর টোপ ছোঁড়ে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করল সে কি বৈশালীকে অন্য কারো সাথে দেখেছেন? এ বিষয়ে ববিতা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ তিনি তার গাড়িতে দুইজন লোক নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।

নিজের ফাঁদে আটকা পড়া ববিতা:

এবার পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ববিতাকে এমন এক ব্যক্তির ছবি দেখাল, যার সঙ্গে বিষয়টির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ববিতা নিজে যেহেতু বিষয়টি এড়াতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে বৈশালীর সঙ্গে একই ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছেন বলেন, যার ছবি পুলিশ তাকে দেখিয়েছিল। অর্থাৎ ববিতা যে এখনও মিথ্যা বলছেন তা স্পষ্ট হয়ে গেল। পুলিশ এর মিথ্যার মুখে এভাবেই সে ফেঁসে যায়। এরপর ববিতা শুধু নিজের অপরাধ স্বীকারই করেননি, নিজের বন্ধুকে হত্যার পেছনের একটি গল্পও বলেছেন, যা জেনে পুলিশ সদস্যরাও বিস্মিত।

২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে খুন ববিতা:

বৈশালীর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে এই খুন করেছে। হ্যাঁ, যে ২৫ লাখ টাকা দিয়ে বৈশালী একবার ববিতাকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করেছিল।

আসলে বৈশালী ও ববিতা দুজনেই একে অপরকে প্রায় এক বছর ধরে চিনত। দুজনেই ভালো বন্ধু ছিল। এদিকে ববিতার টাকার প্রয়োজন হলে বৈশালী তাকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ হিসেবে মোট ২৫ লাখ টাকা দেয়। এখন বৈশালী এই টাকা ফেরত চাইছিল, কিন্তু ববিতা টাকা ফেরত দিতে চায়নি। ধীরে ধীরে ২৫ লাখ টাকা ঋণের কারণে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা আসতে থাকে।

এরই মধ্যে ববিতা তার কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুকে এই ঘটনাটি বলেন এবং বলেন যে তিনি এখন তার বন্ধু বৈশালীর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চান, কারণ তিনি তার কাছ থেকে নেওয়া ২৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে চান না এবং এর জন্য বৈশালীকে খুন করা হবে। ববিতার ওই ফেসবুক বন্ধুরা আসলে সুপারি কিলার ছিল। তারা বৈশালীর প্রাণ নিতে রাজি হলেও এর জন্য দশ লাখ টাকা দাবি করেন। ববিতা তাদের সাথে দর কষাকষি শুরু করে এবং বৈশালীকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর পরিকল্পণা অনুযায়ী ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ববিতা ও দুই সুপারি খুনি ভালসাদের পারডি এলাকায় একটি খালি হীরার কারখানায় পৌঁছায়। ববিতা বৈশালীকে তার ধার করা টাকা ফেরত দিতে প্রলুব্ধ করে এবং তাকে পারদীতে একই হীরার কারখানায় ডেকে নেয়। ধরা পড়া এড়াতে ববিতা তার বাড়ি থেকে স্কুটিতে করে গেলেও কারখানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে স্কুটি রেখে ট্যাক্সি নিয়ে কারখানায় পৌঁছে যান। এখানে তিনি দুই সুপারি খুনিকে নিয়ে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন।

সেখানে বৈশালীর গাড়িতে বসে ববিতা প্রথমে কথা বলতে থাকে এবং পরে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারি খুনিদের দুজনকে খুড়তুতো ভাই বলে বসিয়ে বৈশালীর গাড়িতে বসায়। গাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে দুজনেই প্রথমে বৈশালীকে ক্লোরোফর্ম শ্বাসে অচেতন করে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এ ব্যাপারে ক্লু মুছে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি তার গাড়িতে লাশ নিয়ে নদীর তীরে পৌঁছান এবং গাড়ি ও লাশ অযত্ন রেখে পালিয়ে যান।

ববিতা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ৮ লাখ টাকা, সুপারি খুনিদের দিয়ে দেয় সেই টাকা। এই আট লাখ টাকা বৈশালীকে দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বৈশালীর হাত থেকে রেহাই পেতে একই আট লাখ টাকা সুপারি দিয়ে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে দেন। বর্তমানে পুলিশ ববিতার সাথে পাঞ্জাব থেকে একজন সুপারি কিলারকে গ্রেফতার করেছে, অপরজনের খোঁজে তল্লাশি চলছে।

স্বামী হরেশ ২৫ লক্ষ ধার দেওয়ার কথা জানত না। তবে, ভালসাদ পুলিশ এখন বিষয়টির সমাধান করেছে, তবে গর্ভবতী মহিলার এমন ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র এবং বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প শুনে হতবাক সবাই।

Related posts

বর্ষার সময়ে চিন্তা বাড়াচ্ছে লেপটোসপাইরোসিস সংক্রমন। নিজেকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখবেন

News Desk

ট্রেনের ইঞ্জিনের নিচে শুয়েই ১৯০ কিমি পথ পাড়ি! গয়া স্টেশনে পৌঁছে টের পেলেন চালক

News Desk

কবে মাধ্যমিক -উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা? জানালেন মমতা

News Desk