দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে বছরের পর বছর ধরে চরম দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করছে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই বেকার। হতাশ হয়ে যুবকরা ঘুষের বিনিময়ে কিছু টাকা দিয়ে নিম্নস্তরের চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের অসুবিধা বেশি কারণ চাকরি পেতে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে হয়, যার কারণে অনেক মেয়েই এইডসের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এই তথ্য সামনে এসেছে।
নরম্যান চিসুঙ্গা সেই কয়েকজন যুবকদের মধ্যে একজন যারা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি চাকরির সন্ধানে রাজধানী হারারেতে তার মামার কাছে যাওয়ার জন্য তার গ্রাম ছেড়েছিলেন। তার একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। তার মামা রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল শহর এমবারে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন।
২৪ বছর বয়সী চিসুঙ্গা আলজাজিরার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ২০১৭ সালে, তিনি হাই স্কুল ডিপ্লোমা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি যেকোনো ধরনের চাকরি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও চাকরি হয়নি।’
চিসুঙ্গার মতো, জিম্বাবুয়ের প্রতিটি যুবক চাকরি খুঁজছে, কিন্তু কেউ কাজ পাচ্ছে না। দেশের ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই জীবিকার জন্য কোনও না কোনও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে কারণ লোকেরা দেশে কোনও কাজ পাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে, চিসুঙ্গা ভাগ্যবান যে তিনি হারারে পৌঁছানোর কয়েক সপ্তাহ পরে একটি চাকরি পেয়েছিলেন। তার মামা তাকে স্থানীয় একটি সার কোম্পানিতে চাকরি দেন। কিন্তু এই কাজের জন্য তাকে ঘুষ হিসেবে কিছু টাকা দিতে হয়েছে। চাকরির প্রয়োজন ছিল, তাই নিয়োগকর্তাকে টাকা দিতে হয়েছিল। “আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে চাইনি,” চিসুঙ্গা বলে৷
চিসুঙ্গাকে ছয় মাসের চুক্তিবদ্ধ কাজের জন্য প্রায় ১০০ ডলার ঘুষ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তার কাছে এত টাকা ছিল না, তাই প্রথমে তিনি ছয় সপ্তাহের চাকরির জন্য ৩০ মার্কিন ডলার (12 হাজার জিম্বাবুয়েন ডলার) প্রদান করেন।কোম্পানীতে কাজ বলতে যা তাকে করতে হতো তা হলো ৫০ কেজি ওজনের সার পিঠে তুলে সঠিক জায়গায় রাখা।
কাজের জন্য অর্থ বা যৌনতা:
সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা জিম্বাবুয়ের অনেক যুবকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যেখানে লোকেরা বলেছে যে তারা হয় নিয়োগকর্তাকে সর্বনিম্ন স্তরের চাকরির জন্য অর্থ প্রদান করেছে বা বাধ্য হয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। ২৪ বছর বয়সী বিউটি থেরাপিস্ট তরুণী তায়ানা কুতেউরা, যিনি এখন রাজধানী হারারেতে একটি দোকানে কাজ করেন, আল জাজিরাকে বলেছেন “আমি একটি সুপার মার্কেটে চাকরি চেয়েছিলাম,” । ম্যানেজার চাকরির জন্য ৫০ মার্কিন ডলার দাবি করছিলেন। তখন আমার কাছে টাকা ছিল না কিন্তু চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। তখন আমাকে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে বলা হয়।
কুতুরার মতো যুবতী মহিলাদের মধ্যে অনেককেই প্রায়শই চাকরির বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্ক করতে বলা হয়। কুতুরা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, ‘একটি চাকরির জন্য আমাকে আরেকটি একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার আমি ক্যান্টিন পরিচালনার কাজ পেয়েছিলাম কিন্তু বলা হয়েছিল যে আমি সেখানে মালিকের সাথে শুলে তবেই আমি কাজ পাব। আমি সেই চাকরি নিইনি।’
কুতুরা আরও বলেন, ‘আমি একটি মেয়েকে চিনি যে চাকরির সন্ধানে এই ভাবে যৌন সম্পর্ক করে এইচআইভিতে (HIV) তে আক্রান্ত হয়েছিল। একটি নতুন সুপারমার্কেটের মালিক তাকে যৌনতার বিনিময়ে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে রাজি হয়ে কাজ নেয়। চাকরির টাকা দিয়ে একটা গাড়িও নেয়, এমনকি কিছুদিন পর সুপার মার্কেটের ম্যানেজারও হয়ে যায়। কিন্তু এখন সে এইচআইভি পজিটিভ।
তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার কবলে জিম্বাবুয়ে:
জিম্বাবুয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়েছে। সেখানে মূল্যস্ফীতি চরমে এবং দেশ অনেক প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। দেশের উৎপাদনও কম এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য। ২০০৯ সালে, দেশটি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মার্কিন ডলার কে নিজেদের মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু এর অসন্তোষজনক ফলাফলের কারণে, ২০১৯ সালে আবার জিম্বাবুয়ে ডলার গ্রহণ করা হয়েছিল। এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১০০ শতাংশ।
বেকারত্ব এর জ্বালায় মরিয়া মানুষদের সুবিধা নিতে জিম্বাবুয়েতে কিছু মানুষ এর লাভ নিতে শুরু করেছে। কোম্পানিতে কর্মরত ম্যানেজার বা উচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিরা ঘুষ ও যৌনতার বিনিময়ে মানুষকে চাকরি দিচ্ছেন এবং প্রচুর টাকা কামাচ্ছেন।
স্বজনপ্রীতি পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে:
জিম্বাবুয়েতে ম্যানেজার-স্তরের লোকেরা কোম্পানির বেশিরভাগ পদ তাদের আত্মীয়দের জন্য সংরক্ষণ করে। জিম্বাবুয়েতে এটি সাধারণ বিষয়। এটি পরিস্থিতি আরো জটিল করছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজি কনসালট্যান্টস (আইপিসি), একটি নেতৃস্থানীয় জিম্বাবুয়ে-ভিত্তিক মানব সম্পদ পরামর্শক সংস্থা, ২০২২ সালে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ২৭.৩৯ শতাংশ লোক বলেছেন যে তাদের কোম্পানিতে স্বজনপ্রীতি বিরাজ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চিকিৎসা সেবা শিল্পে সবচেয়ে বেশি ৫২ শতাংশ স্বজনপ্রীতি রয়েছে। এর পরে এফএমসিজি খাতে ৪২ শতাংশ এবং মিডিয়ায় ৪০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বজনপ্রীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।