হিন্দুদের কাছে পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম হচ্ছে ৫১টি শক্তিপীঠ৷ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ইত্যাদি জায়গায় অবস্থিত এই শক্তিপীঠগুলিতে লেগে থাকে ভক্তদের আনাগোনা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী সতীর দেহত্যাগ করলে দেবাদিদেব তা জানতে পেরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন৷ দেবাদিদেব মহাদেবের তান্ডব লীলা কেঁপে ওঠে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল। ধ্বংসের মুখে দাঁড়ায় গোটা সৃষ্টি। তটস্থ হয়ে যান দেবতারা৷ সেই সময় বিষ্ণুর সন্নিকটে সমাধান চেয়ে শরণাপন্ন হন তাঁরা৷ সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণু নিজের সুদর্শন চক্র নিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দেন৷ এই দেহাংশগুলি যেখানে যেখানে পড়ে সেই সেই জায়গাতেই গড়ে হয়েছে শক্তিপীঠ৷ শুধু শাক্তরাই নন, সকল হিন্দুদের কাছেই এই ৫১ টি শক্তিপীঠ তীর্থস্থান হিসেবে ভীষণ পবিত্র।
জ্বালামখী মাতার শক্তিপীঠ, সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম। ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় এই মন্দির অবস্থিত। পুরাণ অনুযায়ী সুদর্শন চক্রের আঘাতে সতীর খন্ড বিখন্ড দেহের জ্বিভা এখানে পড়েছিল। তৎকালীন সময়ে সেখানকার রাজা ছিলেন ভূমিচাঁদ। একদিন রাতে ঘুমানোর সময় তিনি স্বপ্ন দেখেন এই উপত্যকায় মন্দির তৈরির নির্দেশ। তারপর তার দ্বারাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। দেবী এখানে সিদ্ধিদা বা অম্বিকা রূপে পূজিতা। এই স্থানে জিভ পড়লেও দেবীর জিভ রূপি কোনো আকৃতি নয় এখানে পূজিত হয় এক অনন্ত লকলকে অগ্নিশিখা। অনির্বাণ জ্যোতির সমাহার। একটি নয়, সাত-সাতটি। দেবীর জিহ্বা এই স্থানে পড়ে ছিল বলেই অগ্নিময় জিহ্বা রূপেই ভক্তদের দর্শন দেন দেবী।
কালী,করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধুম্রবর্না, স্ফুলিঙ্গিনী এবং বিশ্বরূপী – এই সাতটিকে হিন্দু ধর্মে মানা হয় অগ্নির জিহ্বা। কালী অগ্নির সপ্তম জিহ্বা। হিমাচলের জ্বালামুখী মন্দিরে সাতটি অনির্বাণ জ্যোতি রূপেই ধরা দিয়েছেন দেবী। শুধু তাই নয় দেবীর সাতটি রূপে এখানে পুজো পান। বিন্ধ্যবাসিনী, হিঙ্গলাজ মাতা, অন্নপূর্ণা, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, ও অম্বিকা। আর ভৈরব এখানে রয়েছেন উন্মত্ত। আর এই মন্দিরের শিখা অনন্তকাল ধরে জ্বলছে।
লোকো শ্রুতি অনুযায়ী আছে অনেক রাজাই নাকি অবিশ্বাস করে এই অখণ্ড জ্যোতি নেভানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। সম্রাট আকবর একবার এখানে এসে কিছু লোকের পরামর্শে নিকটবর্তী ঝরনার জলকে আটকে রেখেছিলেন অখণ্ড জ্যোতি ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাভ হয়নি। সেই বাঁধ দেওয়া জলাশয়টি আজও রয়েছে এই স্থলে। তার নাম গৌরীকুণ্ড। মন্দিরের আগত ভক্তরা কুণ্ডটিও দর্শনে যান। এর পরই সম্রাট আকবর জ্বালামুখী দেবীর জন্য সোনার ছাতা গড়িয়ে দেন। কিন্তু জনশ্রুতি দেবী সম্রাটের অহংকার আঁচ করতে পারেন। দেওয়ার সাথে সাথেই সেই সোনার ছাতা অনির্বাণ শিখার আগুনে পুড়ে যায়। এমনকি একবার ওরঙ্গজেব এই মন্দিরের উদ্দেশ্যে আসার সময় কোনো অজ্ঞাত কারণে কাংরা উপত্যকা থেকেই পালিয়ে যান। তবে এত জনের এত চেষ্টার পরও অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকায় সকলেই নতমস্তকে ওই মন্দিরে, ওই জ্যোতির মাধ্যমে দেবী জ্বালামুখীর আশীর্বাদ নেন।