কলকাতা ইতিহাসের সাথে যদি কোনো দেব দেবী সবচেয়ে বেশি যোগ থাকে তাহলে সেটা দুর্গা ঠাকুর নয়, কালী ঠাকুর। মনে করা হয় কালীক্ষেত্র থেকেই নাম এসেছে কলিকাতা। আর এই কলকাতার সব থেকে প্রাচীন কালীমন্দির হল কালীঘাটের কালীমন্দির। বলা যায় কলকাতা নগরীর পত্তনের অনেক আগে থেকেই এই স্থানের অস্তিত্ব বজায় ছিল। কালীঘাটের কালীমন্দির হল একান্নটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম এক সতীপীঠ। অর্থাৎ একান্নপীঠের এক পীঠ। পুরাণ অনুযায়ী , এখানে দেবী সতীর ৫১টি দেহখণ্ডের মধ্যে ডান পায়ের কনিষ্ঠা আঙুলটি পড়েছিল। এটি একচল্লিশতম সতীপিঠ।
বর্তমান কালীঘাটের যে কালীমন্দিরটি আমরা দর্শন করি সেটি ১৮০৯ সালে তৈরী হলেও কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই সতীপীঠ বহুযুগ ধরে জঙ্গলে আবর্ত ছিল। জনশ্রুতি এক ব্রাহ্মণ গঙ্গাতীরে সন্ধ্যাবেলার আহ্নিক সেরে ফেরার সময়ে একটি রহস্যময় জ্যোতি উৎস দেখে সেটি অনুসরণ করে এগিয়ে গিয়ে কালীকুণ্ড নামে পুকুরের পাশে দেবীর মুখায়বের মতন একটি পাথরের টুকরো এবং একটি প্রস্তরীভূত পায়ের আঙুল দেখতে পান। বলা হয় এরপর দেবী তাকে দৈববাণী দেন প্রতিষ্ঠার। কিন্তু এই ঘটনার সাল-তারিখ বা ঘটনার সত্যতা বিষয়ক নথি খুজেঁ পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ২০০০ বছর আগের গ্রীক দার্শনিক টলেমির নিজের ভারতের বর্ণনায় কালীগ্রামের উল্লেখ করেছেন যা আসলে আজকের কালীঘাট। ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতি সওদাগর তার পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে সপ্ত ডীঙায় চরে আদিগঙ্গা দিয়ে যাবার সময় এই কালীমন্দিরে পূজা দিয়েছিলেন।
এছাড়া ১১৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এই জায়গাটি কালীক্ষেত্র নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সেই সময়ে বহু তীর্থযাত্রী গঙ্গাতীরে অবস্থিত কালীক্ষেত্রে স্নান করতে আসতেন এমন বর্ণনা পাওয়া যায়।
সেই সময় যদিও এই কালীক্ষেত্রের বিস্তৃতি ছিল বহুলা (বেহালা) থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার জায়গা। এর মাঝে তিনকোনা ৩ কিলোমিটার জায়গাকে অতি পবিত্র দেবীর স্থান রূপে মানা হত। এই তিন কোনা স্থানের তিনটি কোণে অধিষ্ঠিত ছিল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মন্দির। এই ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চলের মধ্যে কোন এক স্থানে পুরাণ অনুযায়ী সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে সতীদেহের পায়ের বাম পায়ের কনিষ্ঠ আঙ্গুল পড়েছিল। সেই জন্য সেখানে এক দেবীমূর্তি ও একটি ভৈরব মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা হয়। ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর আর দেবী হচ্ছেন কালী।
এই অঞ্চলে তখন বাস ছিল মূলত জেলে, দুলে,বাগদী প্রভৃতি আদিবাসীদের। কিছু তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ তীর্থ যাত্রী মাঝে মাঝে এখানে আসতেন। তারপর ৩০০ বছর কালীঘাট বা গঙ্গার কোন ইতিহাসের উল্লেখ মেলে না।
বর্তমানে, প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তির তিনটি বিশালাকৃতি চোখ, একটি দীর্ঘ প্রসারিত জিহ্বা এবং চারটি হাত যা সোনার নির্মীত। এখনকার মন্দিরটি বরিশাল এর সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী ও তার রামলাল এবং ভাতুষ্পুত্র লক্ষীকান্তর উদ্যোগে, আদি গঙ্গার তীরে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। এই মন্দিরটির উচ্চতা ৯০ ফুট। এটি সম্পূর্ন হতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। সেই সময় ব্যায় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। জমির পরিমাণ ১বিঘা ১১ কাঠা ৩ ছটাক।