কিছুদিন আগেই সারা দেশেই ধুমধাম সহ পালিত হয়েছে ভারতের শিক্ষক দিবস! ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনকে স্মরণীয় করতে এই দিন দেশ জুড়ে শিক্ষকদের সন্মানিত করার রীতি মানা হয়। কিন্তু শিক্ষকের অবস্থা কতোটা ভালো। সত্যিই কি এই শিক্ষক দিবসের যথার্ততা আছে? সম্প্রতি আজতক বাংলায় প্রকাশিত শ্রী বিশ্বজিৎ বন্দোপাধ্যায় – এর প্রতিবেদনে তুলে ধরা নদিয়ার শান্তিপুরের বিজ্ঞান শিক্ষকের এক অসহায় দশা শিক্ষকতার সাথে জড়িত মানুষদের অবস্থা ঘিরে প্রশ্ন তুলে দিল।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে গত প্রায় ১০ বছর ধরে, খই মুড়ি খেয়ে মাটিতে শুয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছে নদীয়ার শান্তিপুরের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সোমনাথ রায়। মা-বাবার মৃত্যুর পর থেকে সে এই ভাবেই চলে আসছে।
নদিয়ার শান্তিপুরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের জলেশ্বর তিলিপাড়ার বাস এই শিক্ষকের। অঙ্ক ফিজিক্স ,কেমিস্ট্রি এর পাশাপাশি ইংরেজির শিক্ষক এই সোমনাথ রায় তার পিতা মাতার মৃত্যুর পর গত টানা ১০ বছর ধরে মুড়ি খইয়ের উপর নির্ভরশীল হয়েই দিন কাটাচ্ছেন।
ঘোর বর্ষার মধ্যেও ঝোঁপ জঙ্গলের পাশে এক ছোট্ট বারান্দায় মাটিতেই তিনি শুয়ে থাকেন। প্রচণ্ড মেধাবী এই শিক্ষকের অ্যাক্যাডেমিক রেকর্ডস অর্থাৎ তার বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিএ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের প্রাপ্ত নম্বরই তার মেধার পরিচয় বহন করছে। আগের সময়ে তিনি সব পরীক্ষাতেই পেয়েছেন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ নম্বর। যা তৎকালীন সময়ে খুব একটা শোনা যেত না।
সোমনাথ রায়ের পিতা প্রদ্যূৎ রায় পেশায় ছিলেন রাজ্য সরকারের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির বেলগাছিয়া শাখার সিনিয়র সাইন্টিস্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট। সোমনাথবাবুর মাও ছিলেন আশুতোষ কলেজের কৃতি এক ছাত্রী। এমন কৃতী পিতা মাতার সন্তান সোমনাথ রায় শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রতি বছর পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনও করতেন। ১৯৮০ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং ৭৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন। এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে ৬৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন তিনি। তিনি ১৯৮০ সালে মাধ্যমিকের পর ৮৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক দেন। মাঝে কয়েকটি বছর এক মূত্রাশয় সংক্রান্ত সমস্যার জন্য পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের খুব ভালো নম্বরের সাথে তিনি পাস করেন। এরপরই ভাগ্য অন্তরায় হয়। বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্নাতক স্তরে আর তার পরীক্ষাতে বসা হয়নি।
পড়াশোনার প্রতি ভীষণ আগ্রহ থাকলেও বাবার শারীরিক ভাবে অসুস্থতার কারণে তিনি সংসারের হাল ধরতে প্রাইভেট টিউশনের পথ বেছে নেন। ২০০৭ সালে সোমনাথ বাবুর পিতার মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় তার মায়ের মৃত্যু হয়। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে গবেষণা করার ইচ্ছা থাকলেও সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় মানসিক ভাবে কিছুটা ভেঙ্গেও পড়েন তিনি।
পিতৃপুরুষ -এর সম্পত্তি আর জমিজমা বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে থাকলেও তা দেখভালের অভাবে হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ইদানিং কালে সোমনাথ বাবুর ঠাকুরমার এক নিকট আত্মীয়ের অনুমতিপূর্বক শান্তিপুরে একটি বাড়িতে বাস করেন তিনি। মা মারা গেলে ঘর সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র গরিব-দুঃখীদের দান করে, তিনি খুব সাধারণ ভাবে মাটিতে শুয়েই জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। রান্না বান্নাও করেন না তারপর থেকে! নানান শুকনো খাবার যেমন মুড়ি,খই ,পাউরুটি এই সব জাতীয় খাবার খেয়েই দিন গুজরান হয় তার। ছাত্রদের দেওয়া টাকা পয়সা হাতে আসলে খুব বেশি হলে কিছু আনাজপাতি একত্রে সেদ্ধ করে খেয়ে থাকেন।
করোনা মহামারীর পূর্বে গোটা ৫০ জনের মতো জন ছাত্র পড়াতেন সোমনাথ বাবু। কিন্তু এই সময়ে বন্ধ তার প্রাইভেট শিক্ষকতা। গত প্রায় দেড় দুই বছর ধরে দুরবস্থার মধ্যেই দিন কাটছে তার। তার শিক্ষকতায় শিক্ষিত হয়ে বহু কৃতী ছাত্র-ছাত্রী আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নানান সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলান তারা। সেই ছাত্র ছাত্রীরাই মাঝেমধ্যে পাঠান সোমনাথ বাবুকে পাঠান গুরুদক্ষিণা।
(তথ্য সংগ্রহ: Aajtak Bangla)