‘যুদ্ধ’ শব্দটি কল্পনা করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কামান, ট্যাংক , অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিপক্ষকে হামলা করার দৃশ্য। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কখনো কখনো কখনো কয়েক দিন, মাস বা বছরভরও চলে। ইতিহাসের পাতায় তাকালে এমন বহু উদাহরণ দেখা যায় যেখানে বছরের পর বছর চলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ভিয়েতনামের যুদ্ধ। কিন্তু আজ এখানে এমন একটি যুদ্ধের বিষয়ে বলবো যেটি চলেছিল মাত্র ৩৮ মিনিট। ‘গিনিস বুক অফ রেকর্ডস’ অনুযায়ী এই যুদ্ধই হচ্ছে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বা ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ। তবে যতই ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ হোক না কেন এই যুদ্ধের গুরুত্ব কিন্তু মোটেও কম ছিল না। কারণ এই যুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরবর্তী বহু দশকের জন্য পরাধীন হয়ে যায়।
ঊনিশ শতাব্দীর শেষের দিকের কথা। সেই সময় তাঞ্জানিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী কয়েকটি দ্বীপ দ্বারা গঠিত জাঞ্জিবার ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এটি ছিল একটি আধা সায়ত্ব শাসিত অঞ্চল। ওই সময় হামিদ বিন তোয়াইনি ছিলেন জাঞ্জিবারের সুলতান। আধা স্বায়ত্ব শাসন বলা হচ্ছে কারণ ব্রিটিশরা তখন ব্যবসাকে হাতিয়ার করে জাঞ্জিবারে নিজেদের অধিপত্য অনেকটাই বাড়িয়েছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন সুলতান হামিদ বিন তোয়াইনি এর মৃত্যুর পর গদিতে বসানো হবে হামাদ বিন মুহাম্মদকে। যাতে করে বিন মুহাম্মদ এর মাধ্যমে তারাই জাঞ্জিবার এর সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে এবং জাঞ্জিবার তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়।
কিন্তু ঘটনা অন্য মোড় নেয় যখন ঊনবিংশ ২৫ আগস্ট, ১৮৯৬ সালে মারা যান জাঞ্জিবারের সুলতান হামিদ বিন তোয়াইনি। ১৮৮৬ সালে জাঞ্জিবার সুলতানাত ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সুলতানের মৃত্যুর পর নতুন কেউ সেই দেশের সিংহাসনে বসতে হলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ব্রিটিশদের অনিচ্ছা সত্বেও সিংহাসনে বসেন খালিদ বিন বারঘাস এবং তিনি কোন অনুমতি নেননি। ব্রিটিশরা এটা মেনে নেয় না।
ব্রিটিশরা বারবার চোখ রাঙালেও খালিদ ব্রিটিশদের হুমকি উপেক্ষা করে তাঁর সৈন্যদেরকে ক্যাপ্টেন সালেহর তত্বাবধানে রাখেন। আর ক্যাপ্টেন সালেহকে নির্দেশ দেন রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার। সমুদ্রের পাড়ে সুলতানের রাজকীয় প্রাসাদ থাকলেও সেই রাজপ্রাসাদে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ছিল না। জানা যায় খালিদ সুলতান হওয়ায় পর মাত্র একদিন সময় এর মধ্যেই স্থানীয় লোকদের ধরে সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করেন। এইভাবে একটি ২,৮০০ সদস্যের একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। কিছু অস্ত্রশস্ত্র, মেশিনগান, গ্যাটলিং গান ও একটি ব্রোঞ্জ নির্মীত কামানের মাধ্যমে গড়ে তোলেন একটি সশস্ত্র বাহিনী। এছাড়া ‘এইচএইচএস গ্ল্যাসগো’ নামের একটি যুদ্ধ জাহাজ যা একসময় ব্রিটিশ রানী জাঞ্জিবারের সুলতানকে উপহার দিয়েছিলেন আর সাথে কিছু সৈন্যের মাধ্যমে সাজান রণতরীও।
ব্রিটিশরা খালিদকে ১৮৯৬ সালের ২৭ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সময় দেন। জানিয়ে দেন এর মধ্যে যদি তিনি পতাকা না নামিয়ে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ না করেন, তাহলে তারা আক্রমণ করতে বাধ্য হবে। ব্রিটিশ কূটনৈতিক বাসিল কেভ খালিদকে আলোচনার মাধ্যমে বোঝাতে চাইলেও কোন লাভ হয় না।
ফলে ইসরা ব্রিটিশরা নিজেদের রণকৌশলে নিপুণ ১,০৫০ সৈন্য আর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাঁচটি রাজকীয় যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়।
১৮৯৬ সালের ২৭ অগাস্ট। আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে ঘড়িতে তখন ৯টা ২মিনিট বেজেছে। ব্রিটিশরা রাজপ্রাসাদের দিকে লক্ষ্য করে প্রথম গোলা ছোড়ে। শুরু হল যুদ্ধ। জবাবে সুলতান বাহিনীর পক্ষ থেকেও গুলি ছোড়া শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে গড়ে তোলা সুলতানের সেনারা এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে যাতে কোনো প্রতিরোধ হয়না। এদিকে নিপুণ ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণে অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন ধরে যায় রাজপ্রাসাদে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী সুলতানের নৌবহর ‘এইচএইচএস গ্ল্যাসগো’ যুদ্ধজাহাজটিও গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়। ব্রিটিশ বাহিনী আক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দিশেহারা সুলতানের সৈন্যরা পালিয়ে যেতে থাকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই যুদ্ধের ভবিতব্য কী হতে চলেছে দেখে সুলতান খালিদ ব্রিটিশদের শত্রু জার্মানদের সহায়তায় পালিয়ে যান। মাত্র ৩৮, মিনিটের মাথায় ৯টা বেজে ৪০ মিনিটে ব্রিটিশ সৈন্যরা রাজপ্রাসাদে ঢুকে আগুন দিয়ে পতাকা পুড়িয়ে দেয়। সমাপ্ত হয় যুদ্ধের। ক্ষণস্থায়ী হলেও এই যুদ্ধে সুলতান বাহিনীর প্রায় ৫০০ জন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মাত্র ১ জন ব্রিটিশ নাবিক আহত হয়। জাঞ্জিবারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশদের একচ্ছত্র অধিপত্য। হামাদ বিন মুহাম্মদকে ব্রিটিশরা বসায় মসনদে।৬৭ বছর ব্রিটিশরা জাঞ্জিবারের উপর নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চলাকালীন ১৯১৬ সালে ব্রিটিশের হাতে আটক হন খালিদ। তিনি আর কখনোই জাঞ্জিবারের সিংহাসন দাবি করবেন না- এই শর্তে ব্রিটিশরা খালিদকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। ১৯২৭ সালে মোম্বাসায় নির্বাসনে থাকার সময় খালিদ বিন বারঘাস মৃত্যুবরণ করেন।
হিসাব করলে দেখা যায় যুদ্ধে ব্যয়িত মোট সময় ৩৮ মিনিট। পৃথিবীর ইতিহাসে চলা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ এটি। অনেকেই এই যুদ্ধকে উপহাস করে “দ্য ব্রেকফাস্ট ওয়ার” নাম দিয়েছেন।