এখনো ১৬ বছর বয়স পার হয়নি। বেঁচে থাকলে আগামী বছর মাধ্যমিক দিতে পারতো ছেলে টা। অবশ্য পড়াশুনোতে একটুও ইচ্ছা তার ছিল না। বই খাতা বাদ দিয়ে সারাদিন মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই দিন কাটতো তার। অনলাইন গেমের প্রতি তীব্র আসক্তি ছিল তার। আর সেই গেমের নেশায় এতই বুদ হয়েছিল যে দুর্দান্ত এক বাইক কিনবে এমনও স্বপ্ন দেখছিল সে।
কোনোরকম টাকা দেওয়া হয়নি বাড়ি থেকে তার এই আকাশ কুসুম স্বপ্নের জন্য তাই ফ্রি ফায়ার গেম খেলে টাকা রোজগার করে বাইক কিনবে ভেবেছিলো অতনু দে। আর সেই গেম থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই বাইক কিনবে ভেবেছিলাম সে। সেকেন্ড হ্যান্ড দামি বাইক কিনবে বলে ৫০০০০ টাকাও অগ্রিম দিয়েছিলো অভিযুক্ত সত্যেন্দ্র ওরফে জামাইকে। সেই দামি বাইক কেনার স্বপ্নই জীবন টা শেষ করে দিল,তার সাথে প্রাণ কেড়ে নিল তার পিসতুতো ভাই অভিষেক নস্করের।
অতনু দমদম পার্কের কৃষ্ণপুর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের দশম শ্রেণির ছাত্র, তারই বন্ধু এবং প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, অনলাইন গেমে অতনুর খুব হাতযশ ছিল। প্রচুর টাকা কামাত গেম খেলে। সবসময়ে পাঁচ-দশ হাজার টাকা তার পকেটে থাকতো। বন্ধুদের নামিদামি রেস্তরাঁয় তা দিয়ে খাওয়াতও সে। রাস্তাঘাটে কোনও ভিখারি অথবা গরিব মানুষ দেখতে পেলেও দু’হাতে টাকা বিলোতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত উদার ছেলেটা। আর সে প্রায়ই বন্ধুদের কাছে গল্প করত, একটা ভালো মডেলের বাইক কিনবে। তিল তিল করে তার জন্য টাকা জমাচ্ছে। বাইক চালানোটা আগেই শিখে নিয়েছিল। একটা স্কুটি ছিল তার বন্ধু রানা গঙ্গোপাধ্যায়ের। বাইকে হাত পাকিয়েছিল অতনু সেই স্কুটিটা মাঝে-মধ্যে চালিয়েই। কখন কোন মডেলের বাইক বাজারে আসছে, সে সবের নিয়মিত খোঁজখবর রাখত। সে জামাইয়ের বাইক পার্টসের দোকানে তার জন্যই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিত। সত্যেন্দ্রর কাছ থেকে কোন গাড়ি কত স্পিডে চলতে পারে, তার ইঞ্জিনের ক্ষমতা কত, সেই সব খবর নিত। পুলিশের অনুমান,সম্ভবত সত্যেন্দ্রর খপ্পরে সেই বাইক কিনতে গিয়েই পড়ে যায় অতনু।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, তাকে টোপ সত্যেন্দ্রই দেয়, সেকেন্ড হ্যান্ড দামি মডেলের একটি বাইক কেনার জন্য। অতনু মাঝেমধ্যেই রাস্তায় বের হতো সত্যেন্দ্রর দেওয়া একটি দামি বাইক নিয়ে। তবে সে সত্যেন্দ্র ওরফে জামাইকে যে সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মা-বাবা। সত্যেন্দ্র বাইকটার ১ লক্ষ টাকা দাম চেয়েছিল। মাসখানেক আগেই মিটিয়ে দিয়েছিল অতনু যার অর্ধেকটা। ১৮ অগস্ট বাকি টাকা মেটানোর কথা ছিল। কিন্তু অতনু সেদিন টাকাটা জোগাড় করে উঠতে পারেনি।
পুলিশ এখনও পর্যন্ত তদন্তে জানতে পেরেছে, অতনু তার এক বন্ধু সায়ন ব্যাপারীকে নিয়ে রাজারহাটের লাউহাটিতে শো-রুমে বাইক দেখাতে ১৮ অগস্ট নিয়ে যায় জামাই। কিন্তু তাদের নিয়ে সেদিন শো-রুমে ঢোকেনি সে। পুলিশ সূত্রের খবর, ভিতরে ঢুকতে দেবে না- তাদের মুখে মাস্ক নেই বলে এমন অজুহাত দিয়ে অতনু-সায়নকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণ বাদে জামাই ফিরে আসে। তার পর অনেক রাস্তা ঘুরে-ফিরে রাতে বাড়ি ফেরে তারা। কোনও ভাবে অতনুকে সেদিনই সরিয়ে দেওয়ার ছক ছিল কি না, অথবা সেদিন তার এক বন্ধু থেকে যাওয়ায় সেই প্ল্যান ভেস্তে গিয়েছিল কি না, তা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা। জামাইয়ের সঙ্গে অতনু ফের ২২ সেপ্টেম্বর বাইক আনতে যায় লাউহাটিতে। পিসতুতো ভাই অভিষেক সেদিন তার সঙ্গী হয়। বাগুইআটি হিন্দু বিদ্যাপিঠের দশম শ্রেণির ছাত্র সে-ও। তার বাড়ি বাগুইআটি জোড়ামন্দির অঞ্চলে। তার বাবার দুধের ব্যবসা আছে। সে মাঝে মধ্যেই আসত মামার বাড়িতে গেম খেলতে। কপালজোরে বেঁচে যাওয়া সায়ন বলছিল, ”অসম্ভব প্যাশন ছিল বাইকের প্রতি অতনুর। সারাক্ষণ বাইকের গল্প করত আমাদের সঙ্গে। সত্যেন্দ্রর পিছনে পড়েছিল বাইকের জন্যই। সেটাই ওর জীবনের কাল হল।”