মা কালী শক্তির দেবী। তাকে শ্যামা বা আদ্যাশক্তি নামেও ডাকা হয়। সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষত বাঙালিদের কাছে এই মা কালী বিশেষভাবে আরাধ্য। তন্ত্র মতে পুজো করা হয় যাদের সেই ১০ জন প্রধান দেবীর মধ্যে তিনি অন্যতম পূজিত দেবী। কিন্তু এই দেবী বাঙালির অতি কাছের। মা রূপে সস্নেহে পূজিত হন তিনি। কিন্তু বাঙালির এই কালীপুজোর শুরুর ইতিহাস জানা আছে কি?
বাংলায় কালী কীভাবে শুরু হল
বাংলার বুকে প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমার মাধ্যমে কালী পূজার প্রচলন করেন নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক যার নাম কৃষ্ণানন্দ। ইতিপূর্বে মা কালীর পুজো বা সাধনা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে হত। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে যে কালী মূর্তি পূজার প্রচলন তাকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় আরো জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু বাংলার বুকে। এরও পরে উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের দ্বারা কালীপুজোর প্রচলন ব্যাপক হারে শুরু হয়।
কালী মূর্তি কেমন হবে, সেই রূপটি জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ। দিন রাত এক করে মা কে ডাকতেন উত্তর খুঁজতে। একদিন স্বপ্নে দেখা দিলেন মা। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের ঘোরে আধো-ঘুম আধো-জাগরণে তার কানে এল দৈববাণী। শুনতে পেলেন যে ভোরের প্রথম আধো অন্ধকারে তিনি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ।
ভোর রাতে এমন এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের। দ্রুত নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখনও ঠিক ভাবে ভোরের আলো ফোটেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললেন গঙ্গার ঘাটের দিকে। গোপপল্লির ভেতর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ল এক গোপবধূর উপর (অনেকে বলেন বাগদিবধূ)। ডান পা সামনের দিকে, বাঁ হাতে এক তাল গোবর নিয়ে, ডান হাতে মনোযোগ সহকারে মাটির ঘরের দেওয়ালে গোবরের প্রলেপ দিচ্ছিল ভোর বেলায়। হাঁটু অবধি পরিহিত ছিল তার একটি ছোট শাড়ি। কোমরের নিচে প্রায় হাঁটুর কাছ পর্যন্ত এক মাথা ঘন কালো চুল। পরিশ্রমের ঘামে ধেবড়ে গিয়েছে মেয়েটির সিঁদুরের টিপটি।
কৃষ্ণানন্দ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ে গেল ভোর রাতে স্বপ্নে আসা দৈব বানীর কথা। তিনি লক্ষ করলেন দু’হাতেই গোবর নিয়ে কৃষ্ণানন্দকে হঠাৎ দেখে হতচকিত মেয়েটি তাড়াতাড়ি চেষ্টা করছেন নিজের মাথায় ঘোমটা টানার। লজ্জায় জিভ কাটলেন। এই মেয়েটির মধ্যেই কৃষ্ণানন্দ খুজেঁ পেলেন তাঁর আরাধ্য দেবী কালীর রূপটি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, কোমর ছাপানো খোলা কেশে, দিগম্বরী দেবী… এক পা এখনো আর বাঁ হাঁতে খড়্গ আর ডান হাতে প্রদান করছেন বরাভয়।
এই রূপের সাথে তন্ত্রসাধক দের আরাধ্য কালী হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের শ্যামা। যে কালীপুজো এক সময়ে গৃহে হত না, কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই সেই দেবী প্রবেশ করলেন বাংলার ঘরে ঘরে।